(প্রথম পর্বের পর....)
-"শুভ!" ডাকল কাবিদুল দা।
আমি শুনতে পেয়েও জানলা থেকে মুখ ঘোরালাম না। কাবিদুল দা এবার আমার কাঁধে একটা হাত দিয়ে টোকা দিল।
আমি মুখ ঘোরালাম। দেখি কাবিদুল দা কেকের বাক্সটা আমার দিকে একহাতে এগিয়ে রেখেছে। আরেক হাত স্টিয়ারিং এ, চোখ রাস্তায়।
আমি, "আমি খাবো না। খিদে নেই!" বলে সোজা রাস্তার দিকে তাকালাম। আমার মুখ বাংলার পাঁচ হয়ে আছে।
"মম, মম.." আওয়াজ করে কাবিদুল দা ডাকতে, পাশে মুখ ঘোরাতেই দেখি কেকের একটা স্লাইস হাতে তুলে আমার মুখের কাছে এনে ধরেছে। "খাও! একটা পিস খাও" আমার মুখ থেকে কেকটা এক ইঞ্চি দুরে। আমি চুপ করে রইলাম। একবার কেক একবার কাবিদুল দার দিকে দেখছি।
সে কেকের স্লাইসটা ধরেই বলল, "খেলে আমার ভালো লাগবে!"
শয়তান ছেলে একেবারে। এমন আন্তরিকভাবে, বিনয়ের সাথে বলল কথাটা যে আমি গলে জল হয়ে গেলাম জাস্ট। মুখে করে কেকে কামড় দিলাম। এক কামড়ে পুরোটা মুখে নিতে পারলাম না। যেটুকু হাতে তখনও ধরা ছিল সেটা খেতে গিয়ে আমার ঠোঁট কাবিদুল দা'র হাতের আঙ্গুলে স্পর্শ করল। চুমু খেয়ে ফেললাম নাকি! লজ্জায় মুখ সরিয়ে নিলাম। কাবিদুল দা নিজের কেক ধরা হাতটা একবার দেখে নিজের জামায় হাতটা মুছে নিল।
হাইওয়ে থেকে একটা পাশে বেঁকে যাওয়া রাস্তায় ঢুকলাম। রাস্তাটা তুলনামুলক ভাবে সরু আর গাড়ি, লোকজন এর সংখ্যা বেশি, পাশেই বাজার। কাবিদুল দা নিজের দু হাত ভালো ভাবে স্টিয়ারিঙে রেখে তীক্ষ্ণ চোখ রাস্তায় রেখে আমায় বলল, "কেকটা আমায় একটু খাইয়ে দাও না। মুখে জাস্ট দিয়ে দাও।"
আমার গোটা মুখটা গরম হয়ে গেল কথাটা শুনে। আসতে আসতে কেকের বাক্সটা নিয়ে একটা স্লাইস কাবিদুল দার মুখে ধরলাম। সে হাঁ করে না। আমি বললাম, "এই নাও, খাও"। তাও হাঁ করেনা। আমি স্লাইসটা নিয়ে এবার ঠোঁটে ঠেকাতে, মুখ ফাঁক করল। আমি কেক ভরে দিলাম।
রাস্তার ভিড় বাড়ছে। আমার কেক খাওয়ানো শেষ প্রায়। আমায় কাবিদুল দা বলল বাকিটা খেয়ে নিতে, উত্তরে আমি বললাম, "এই আর এক পিস আছে। তুমি খেয়ে নাও"
কাবিদুল দা, শক্ত হাতে গভীর মনোযোগে গাড়ি চালাচ্ছে, না বলার জায়গাতেও নেই আর। আমি কেকটা মুখে ধরলাম। কাবিদুল দা হাঁ করে মুখে নিতে যাবে এমন সময় হুট করে একটা বাচ্চা ছেলে রাস্তার একদিক থেকে দৌড়ে রাস্তা পার হতে গেল। দিদি, "এই এই আরেহ, আরেহ কাবিদুল..." বলে চেঁচিয়ে উঠল। কাবিদুল দা তৎক্ষণাৎ ব্রেক কষে, উত্তেজনায় আমার আঙ্গুল কামড়ে দিল। আমি তিব্র ব্যাথায়, "আআআহ!!" করে চেঁচিয়ে উঠে হাতটা সরিয়ে নিলাম।
বাচ্চা ছেলেটার মা গাড়ির সামনে, ছেলের হাত ধরে, "দাদা মাপ করবেন, ছেলেটা এত দুরন্ত!! বাবু, দাঁড়া তোর বাবা আসুক আজকে" বলতে বলতে চলে গেল।
আমি ব্যাথায় তখন হাতটা ঝাঁকাচ্ছি। দিদি কি একটা আমায় বলতে গেল, কাবিদুল দা ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে রেগে গিয়ে বলল, "আমি বললাম তো আমি খাবো না!? বললাম তো তোমায় খেয়ে নিতে!!? শুনতে পাওনি কি বললাম!!' বলে সামনে চোখ রেখে গাড়ি স্টার্ট দিল আবার।
গাড়ি চলতে শুরু করল যখন, শুনলাম কাবিদুল দা বিড়বিড় করে বলল, "নামেই পড়াশোনা শিখেছে সব!"
আমার ঠোঁটটা কেঁপে উঠল। রাগে, দুঃখে, অপমানে। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দুটো আঙ্গুলের ডগা কামড়ে একেবারে কালশিটে পরে নিলচে হয়ে গেছে। অন্যকেউ হলে বা অন্যসময়ে আমি ঝেড়ে কাপড় পড়িয়ে দিতাম আমাকে কেউ এভাবে বললে। কিন্তু আমার গলা বুজে এল। কিচ্ছু বলতেই পারলাম না।
গাড়ি প্রায় এসে গেছে দিদির শ্বশুরবাড়ির কাছে। আর ওই ১৫ মিনিট এর রাস্তা, কিন্তু এত জ্যাম যে গাড়ি এগোচ্ছেই না। আমি পাশের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। তাকাবই না ওর দিকে। যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর!!? তোকে খাওয়াতে গেলাম গাড়ি চালাচ্ছিস বলে তাও তুই আমায় বললি বলে, আর আমাকেই বকে দিল তার জন্য!!
মিনিট পাঁচ পরে গায়ে কি একটা ঠেকতে পেছন ফিরে দেখি একটা জলের বোতল আমার কোমরের কাছে পড়ে আছে। পাশে একটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি। আমি শিশির গায়ে দেখলাম লেখা, আরনিকা ২০০। ব্যাথা কমার ওষুধ। আমি আবার মুখ ঘুরিয়ে জানলার বাইরের দিকে করলাম। কাবিদুল দা পাশ থেকে বলল, "ব্যাথা কমার ওষুধ সঙ্গে ইন্টারনাল ব্লিডিং বন্ধ করে। গাড়ির ফার্স্ট এইড বক্সে থাকে।"
আমি বাইরের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে, ধারালো চোখে, দৃঢ় স্বরে বললাম, "তাই নাকি, ভাগ্যিস তুমি বললে, নাহলে তো জানতেই পারতাম না যে আরনিকা মন্টানা কিসে লাগে!!"
দেখলাম স্টিয়ারিঙটা অস্বাভাবিক রকমের শক্তভাবে চেপে ধরল কাবিদুল দা। চোয়াল শক্ত করল। তারপর বাম হাতে ওষুধের শিশি আর জলের বোতলটা সরিয়ে নিল। আমিও সোজা রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম হাতের ওপর হাত বুকের কাছে রেখে।
দিদি পেছন থেকে কি বুঝল জানি না, কিন্তু বেশ বুঝল হাওয়া গরম। মিনমিন করে বলল, "আমাকে একটা মিষ্টির দোকানে একটু নামতে হবে, গাড়িটা একটু একপাশে নেবে!? ওই, ওই যে আসছে ময়ূরী মিষ্টান্ন ভান্ডার, ওখানে, হ্যাঁ... পাঁচ মিনিট জাস্ট"
কাবিদুল দা কোন কথা না বলে, গাড়িটা সাইডে পার্ক করলো। দিদি গাড়ি থেকে মামন কে নিয়ে নেমে গেল। একমিনিট সব চুপচাপ। কাবিদুল দা শান্ত গলায় সামনে তাকিয়ে বলল, "হাতটা দেখি!" আমার টিকি জ্বলে আছে তখন। আমার শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলা!! কে ও!!? যে আমার শিক্ষা নিয়ে আমায় এভাবে অপমান করবে!!?
চুপ করে রইলাম। কাবিদুল দা আমার দিকে ঘুরে একটা ভীষণ বিরক্তি ভরা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল আমার দিকে। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও বুঝতে পারলাম সেটা। তারপর নিজের বাম হাতে আমার ব্যাথা পাওয়া ডানহাতটা আমার বুক থেকে টেনে দেখতে গেল। আমি নিজের হাতটা শক্ত করে বুকের কাছে চেপে রইলাম। এবার কাবিদুল দা গায়ের জোরে আমার ডানহাতটা ছাড়িয়ে আমার হাতটা দেখতে লাগলো।
আমার ঠোঁট কাঁপছে। হার্ট রেট বেড়ে গেছে। কাবিদুল দা, আলতো করে আমার ব্যাথা লাগা আঙ্গুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো, ভালো করে দেখতে লাগলো কোথায় কোথায় দাঁতের দাগ বসেছে। ওর নাকের গরম নিঃশ্বাস পড়ছে আমার হাতে। আমি ভাষায় বোঝাতে পারব না আমার কেমন লাগছিল সে সময়। শুধু চোখ কান খোলা থাকা সত্তেও কিছুই যে দেখতে বা শুনতে পাচ্ছিলাম না, সেটা বলতে পারি।
হঠাত আমার হাত ছেড়ে দিতে আমার হুঁশ ফিরল। দেখি দিদি আসছে রাস্তা দিয়ে। কাবিদুল দা এবার আরনিকার শিশিটা আমার হাতে ধরিয়ে, মুঠো বন্ধ করে দিয়ে বলল, "প্লিজ, ওষুধটা খাও। নাহলে.... ব্যাথা হবে"
আমি ওষুধ মুঠো করে একইভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। কাবিদুল দা মিনমিন করে বলে উঠল, "আই এম সরি!"
আমি পাশ ফিরে বললাম, "কি, কি কি বললে, আরেকবার বল!!?"
কাবিদুল দা, থেমে মাথাটা নামিয়ে, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে স্থিরভাবে বলল, "আমার তোমাকে ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। ভুল হয়ে গেছে। আই এম সরি!!"
আমি শুনে, এক চিলতে হেসে সামনে তাকিয়ে ওষুধ কয়েক ফোঁটা মুখে ফেললাম। দিদি দরজা খুলে মামন কে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল একই সঙ্গে।
আবার গাড়ি ছেড়ে দিল। ফাইনালি আমরা দিদির বাড়ি পৌঁছলাম যখন তখন বাজে পৌনে আটটা।
(ক্রমশ.....)
(অনুগ্রহ করে ব্লগের নিচের কমেন্ট বক্সে জানান, কেমন লাগছে পড়ে। এতে উৎসাহ পাওয়া যায়।)
No comments:
Post a Comment